প্রেম-ভালোবাসা আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি। প্রেম-ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত একটি বিষয়। প্রতিটি মুমিন-মুসলমানের হৃদয়ে মহান আল্লাহর প্রেম-ভালোবাসা থাকা জরুরি।
কম-বেশি সবাই মহান আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসতে চায়, তার ভালোবাসা অর্জন করতে চায়, তবে কীভাবে, কী কাজ করলে, মহান আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা অর্জন হয়, তা অনেকেই জানে না। আল্লাহর পবিত্র ভালোবাসা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ উল্লেখ করা হলো-
মৃত্যুর স্মরণ : মৃত্যু এমন এক সত্য যা একদিন মানুষকে আলিঙ্গন করবেই। পৃথিবীর রং-রসে মেতে, মৃত্যুকে হয়তো ভুলে থাকা যায়, কিন্তু মৃত্যুকে এড়ানো বা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর’ (সূরা নিসা, আয়াত, ৭৫)।
তাই তো যাপিত জীবনে ছোট-বড়, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধর্ম-বর্ণ, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ বিনা বাক্যে মৃত্যুর কথা মেনে নেয় ও বিশ্বাস করে। মৃত্যুর এ বোধ ও বিশ্বাস মানুষ বাস্তবতা থেকেই অর্জন করেছে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো, মৃত্যুর কথা ও মৃত্যু-পরবর্তী জীবন নিয়ে সদা-সর্বদা চিন্তা করা। মৃত্যুর স্মরণ মানুষের ইমানে, আমলে, চিন্তা-চেতনায় প্রভাব ফেলে। তাই তো রাসূল (সা.) মৃত্যুর স্মরণের জন্য উম্মতকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাছাড়া মৃত্যুর স্মরণের মাধ্যমে মহান আল্লাহতায়ালার ভালোবাসা অর্জন হয়।
এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা বেশি বেশি করে স্বাদ হরণকারী বিষয় তথা মৃত্যুর কথা স্মরণ কর’ (ইবনে মাজা : ৪২৫৮)। ওপর এক হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাৎ পছন্দ করে আল্লাহতায়ালা তার সাক্ষাৎ পছন্দ করেন’ (বোখারি : ৬০০২)। আরেকটা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন মৃত্যু মুমিনের জন্য উপঢৌকন স্বরূপ’(শুআবুল ইমান, ৯৭৭৩)।
একনিষ্ঠতা : দুনিয়ার যাবতীয় কাজ ও সবকিছু একমাত্র আল্লাহতায়ালার জন্য হওয়া। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যারা আমার মহব্বত লাভের উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালোবাসে, আমার উদ্দেশ্যে সভা-সমাবেশে উপস্থিত হয়, আমার উদ্দেশ্যে পরস্পরে দেখা সাক্ষাৎ করে আর আমার ভালোবাসা অর্জনের জন্য খরচ করে, তাদের জন্য আমার মহব্বত-ভালোবাসা অবধারিত’ (তিরমিজি : ২৩৯০)।
ওপর এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে এবং তার জন্যই কারও সঙ্গে বিদ্বেষ পোষণ করে এবং তার জন্যই দান করে এবং তার উদ্দেশ্যেই দান থেকে বিরত থাকে, তাহলে সে তার ইমানকে পরিপূর্ণ করল’ (আবু দাউদ, ৪৬৮১)।
আত্মীয়তা বজায় রাখা : সামাজিক জীবনে, সমাজবদ্ধ পরিবেশে, আত্মীয়স্বজন সৌন্দর্যের প্রতীক। সামাজিক জীবনে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা ছাড়া স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপন করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মীয়তার প্রভাব ব্যাপক। তাই তো ইসলাম আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখার জোরালো নির্দেশ দিয়েছে। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘তোমার সঙ্গে যে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তুমি তার সঙ্গে তা বজায় রাখ, তোমাকে যে বঞ্চিত করেছে, তুমি তাকে প্রদান কর এবং যে তোমার প্রতি অন্যায় আচরণ করেছে, তুমি তাকে ক্ষমা করে দাও’ (মুসনাদে আহমদ : ১৭৪৫২)।
সৃষ্টি চিন্তা : পবিত্র কুরআন মাজিদের বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মহান আল্লাহতায়ালার নানাবিধ নেয়ামতরাজির বিস্তারিত বিবরণ। মহান আল্লাহতায়ালা মানব জাতিকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করে তাদের অসংখ্য অগণিত নিয়ামতরাজি দান করেছেন। পৃথিবীর সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও সেসব নিয়ামতরাজি গণনা করে শেষ করতে পারবে না। নিয়ামতের কথা চিন্তা করলে প্রত্যেক ব্যক্তি প্রথমে নিজের দেহের কথাই ভাবতে পারে।
রাব্বুল আলামিন তার মহা-অনুগ্রহে মানুষের দেহে যে প্রাণ সঞ্চার করেছেন সেটিও বড় একটি নিয়ামত। দেহের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরায় নিয়ামত আর নিয়ামত। মানুষের আপাদমস্তক পুরোটাই মহান রবের মহানিয়ামতে ভরপুর। উপরন্তু আকার-আকৃতি, জ্ঞান-বুদ্ধি, সুস্থতা-অসুস্থতা, ঘরবাড়ি, সন্তানসন্ততি, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ইজ্জত-সম্মান, ইত্যাদি বিচিত্র নিয়ামতরাজি বান্দাকে দিয়েছেন।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং স্বয়ং তোমাদের অস্তিত্বেও! তবুও কি তোমরা অনুধাবন করতে পার না?’ (সূরা যারিয়াত : ২১)। এভাবে আল্লাহতায়ালা মানুষকে প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য অগণিত নিয়ামতরাজি দান করছেন। এমন অনেক নিয়ামত রয়েছে, যে নিয়ামতের কথা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সে ঘোষণাও আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন পবিত্র কুরআনে।
ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা কি লক্ষ করনি, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা-কিছু আছে, আল্লাহতায়ালা সেগুলোকে তোমাদের কাজে নিয়োজিত রেখেছেন এবং তিনি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামতগুলো তোমাদের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বর্ষণ করেছেন। আমরা যখন আমাদের যাপিত জীবনে মহান আল্লাহতায়ালার এত বিপুলসংখ্যক নেয়ামতরাজি নিয়ে চিন্তাভাবনা করব, তখন আল্লাহতায়ালার মহব্বত-ভালোবাসা আমাদের দিলে বৃদ্ধি পাবে। তাই তো আল্লাহতায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘সুতরাং (হে মানুষ ও জিন!) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে?’
(সূরা আর-রহমান : ১৩)।